পরিসমাপ্তি ।। সারোক শিকদার
লাশটা চাদরে ঢেকে আমি লিও রোজাসের প্যান ফ্লুট ছাড়লাম। শীতকাল। এক ঝাঁক তীব্র রোদ নিষিদ্ধ সিনেমার পোস্টারের আকৃতিতে লেপটে আছে মেঝেতে অথবা আমি কি এখন তুর পর্বতে দাঁড়িয়ে! দেয়াল ভেদ করে একি ঈশ্বরের আলো! আমার হাতে মসীহের লাঠির আদলে একটি ছুরি, যার জিহ্বা গড়িয়ে লোহিত ধারা নামছে…আঙুল ভিজিয়ে…কব্জি ভিজিয়ে… চকচকে টাইলসের উপর। বিন্দু বিন্দু কৃষ্ণচূড়া। অথচ আরও বেশি অন্ধকার আরও বেশি প্রয়োজন।
জানলার পর্দাটা ঠিক করতে গিয়ে দেখলাম বাইরে বেশকিছু শুকনো পাতার উপর দিয়ে নয় মার্কা চকচকে কাঠবিড়াল ঘুরছে। আমার পরিচিত। একবার ইচ্ছা করছিল ওদেরকে ঘরে আমন্ত্রণ জানাতে। আবার মনে হলো- না, এরকম বুক চেরা লাশ দেখতে নিশ্চয় ওরা সুখ বোধ করবেনা। ফলে আমি পর্দাটা খুব পরিপাটি করে টেনে দিলাম।
বেশ খানিকটা রক্ত ছিটকে দেওয়ালে লেগেছে। এটা আমার অযোগ্যতা। আমি পেশাদার খুনী নই। ফলে বেশ কিছু ভুল ইতোমধ্যে করেছি। যার জন্য নিজের ওপর প্রচন্ড বিরক্তি বোধ হচ্ছে। চেয়েছিলাম খুনটা খুব শৈল্পিক ভাবে করতে। যাতে একটি মৃত্যুকে আমি খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারি।
কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল বলে তাড়াহুড়ো করে সব কিছু করতে হলো।
ইচ্ছা ছিল প্রথমে তার বুকটা চিরে ফেলবার। খুব স্বাভাবিক মুখভঙ্গিমায় ছুড়িটাও তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু খুনীর মুখ লুকিয়ে রাখা যায়না। ফলে ও প্রথমে আঁতকে উঠলো – যেহেতু আমার হাতে বরাবর গোলাপ দেখেই ও অভ্যস্ত। আমি ওর আতঙ্কিত মুখ দেখে পুনরায় প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে আমার হাত আমার প্রেমকে রক্ষার জন্য কিছুই করতে পারলোনা, কারণ সে ধারালো ছুড়িটা বসিয়ে দিয়েছে বুক বরাবর। আমি ভেবেছিলাম ওর বুকটি হবে পাথরের চেয়েও শক্ত। আমার ধারণা ছিল আমি হয়তো প্রথম আঘাতে ছুড়িটিকে গাঁথতে পারবোনা কিংবা ছুড়িটি ফিরে আসবে ওর হিম বরফ পাজর থেকে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ছুড়িটি খুব আয়েশী ভঙ্গিতে ওর বুকটা বিদীর্ণ করে ফেললো। আমি ভাবতাম ওর অপবিত্র রক্তের রঙ নিশ্চয় লাল হবেনা। কেননা ওর মত পাষন্ড আমি কোনদিন আর দেখবোনা। কিন্তু ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা ওর রক্তের রঙ ছিল কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও তীব্র লাল। ওর চোখদুটি আরও বেশী উজ্জল হয়ে উঠলো। আমি ভেবেছিলাম খুব সহজে ও নেতিয়ে পড়বেনা, ওর প্রাণ সূর্যের আয়ুর মতই দীর্ঘ। কিন্তু ও খুব সহজেই নেতিয়ে পড়লো এবং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যেন উপড়ে ফেলা লাউগাছের লাউফুল। ওর মুখ থেকে এক এক করে মুছে যেতে থাকলো পাপ। কিছু পাপ ঝুলে থাকলো ঘরের সিলিংয়ে মাকরসার জালে। মাকরসার জালটি বার কয়েক কেঁপে উঠলো। মাকরসাটি পাপ পছন্দ করেনা। ফলে পাপগুলো পিঠে নিয়ে সে বাইরে চলে গেল। ও খুব অনুনয়ের সুরে বাঁচতে চাইলো, ক্ষমা চাইলো শেষবারের মত। কিন্তু কোন শারীরিক চেষ্টা করলো না। ওর অনুনয় শৈশবে দেখা যাত্রাপালার শেষ দৃশ্যের মুখস্থতায় ঘিরে ফেলল আমাকে ফলে ওর যন্ত্রণায় লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো একটা সিগারেটের তৃষ্ণা বাদে আমাকে আর কিছুই দিলোনা। দীর্ঘদিন দিন ধরে আমি সুচিত্রা সেন দেখিনা, কেনোনা তার চেয়েও তীব্র আর সুক্ষ অভিনয় আমি দেখেছি ওর কাছ থেকে। কিন্তু মৃত্যর সময় কেউ অভিনয় করবে এমন হতে পারেনা। ওর রূপ আমাকে আরেকবার বিচলিত করলো। ফলে আমি আমার প্রেমকে আরো তীব্রভাবে অনুভব করলাম। এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এই প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওর মৃত্যুই একমাত্র সমাধান। মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মুখটা এতটাই শুভ্র আর সুন্দর হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ সঙ্গমাবস্থায় থাকায় বেশ ক্লান্তও ছিল ও। আমি ক্লান্তিকে দীর্ঘ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃত্যুর ক্ষুধায় উন্মত্ত ছুড়িটি তুলে ওর গলায় আড়াআড়ি টান মারলাম। জ্যৈষ্ঠের নদীতে শুশুকের দল যেমন শব্দ করে, তেমনি একটি শব্দ হল…
আমি মৃত্যুটিকে উপভোগ করবার আগেই ওর শরীর নিথর হয়ে গেল। মৃত্যু সম্পর্কে আমার এমন পরিচয় আগে ঘটেনি। কিন্তু রক্তস্রোত দেখে আমার ভেতর আরো বেশী হিংস্রতা সাড়া দিল। ওর নগ্ন শরীরের উপর বসে আছি। আমিও নগ্ন। কারণ সর্বশেষ আমাদের শরীর নিলামে উঠেছিল। ডানহাতের মুঠিতে ব্রাটা শক্ত করে ধরা। বাম হাতে ফুল আঁকা বিছানার চাঁদর। যিশুর মত ভঙ্গি করে ও শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে ও যেন পুনরায় আহ্বান করছে। আমি ওর যৌনাঙ্গ মুখী হলাম আবার যতক্ষণ না ওর জন্য আমার শোক আরো গভীর হল এবং ওর শূন্যতা আমাকে নিঃসঙ্গ করলো। আমার ইচ্ছা হলো ওর স্তন দুটিকে তুলে রাখি। ফলে খুব কসরতে স্তন দুটি কেটে নিলাম। বাম স্তনে একটা তিল শিশির কণার মত জ্বল জ্বল করছে। কর্তিত স্তনটি হাতে নিয়ে ফুলের মত ঘ্রাণ নিলাম। চুমু খেলাম। এই স্তন দুটি আমাকে দীর্ঘরাত জাগিয়ে রেখেছে। স্তন দুটি আমি আমার পুরুষস্তনের উপর রেখে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দীর্ঘক্ষণ দেখলাম। নাহ! স্তন দুটো আমার প্রেমিকার, স্তন দুটো শোভা পায় ওর বুকে, আমার হাতে, আমার ওষ্ঠের স্পর্শে। আমার প্রেমিকার নিথর শরীর এখন কবিতার খাতা, রক্তের কালি জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে বর্ণমালার মত। কিছুক্ষণ আগে সে আমাকে বলেছিল উত্তাপ দিতে এবং তারও আগে সে বলেছিল সে আমার ঋণ পরিশোধ করতে এসেছে। কারণ আমি তার কাছে একটা ছেড়া নোট হয়ে গেছি। মূল্যহীন। যদিও আমাকে প্রেমিক ভাবা হচ্ছে এবং হবে কিন্তু আমার কোন মূল্যমান নেই।
এ স্তনদুটি ওর জন্যই প্রকৃতির কারিগর বহু তপস্যায় সৃজন করেছে এবং এগুলো শুধুমাত্র তার শরীরের সাথেই মানানসই। আমি শিশুর মত সে স্তন অগ্রে জিভ রাখি। ওর নারী অংশ ছুড়ি বসিয়ে ডালিমের মত বিচ্ছিন্ন করি। কোয়ার মত লাল লাল রক্ত কণা। আমি দেখতে পাই সেখানে ওর নতুন অফিস বসের উৎকট হাসি ভাসছে। ওর নতুন অফিসের বস, কোট পরিহিত অবস্থায় যাকে উন্মাদ শুকরের বেশী মনে হয়নি এবং যে তার শিশ্নটিকে টাইয়ের মত সব সময় গলায় ঝুলিয়ে রাখতো। তার সাথেই এদানীং ও শুতো। প্রায়ই শুতো। আমি মানতে পারিনা। যতবার মনে আসে ততবার বিষিয়ে উঠেছে মন। আমি ওকে বুঝিয়েছি। কিন্তু সে আমাকে বোঝাতে চেয়েছে কিছু সস্তা ডাস্টবিনের গল্প। সে বোঝাতে চেয়েছে সময়ের পরিবর্তন। বসের সংস্পর্শে থাকতে পারলে ওর ক্যারিয়ার ডেভেলপ হবে । আমার মত সস্তা কবি আর ডারবী খাওয়া ঠোঁটে এখন আর পোষায়না। আমি তবুও হতাশ হইনি। ক্রমশ আমার হৃদয়ে, পঙ্কতিতে জন্মানো সোনালি ফসল খেয়ে গেছে কর্পোরেট ছাগল। আমার তপস্যার জায়নামাজ পুড়ে গেছে শয়তানের সেজদায়। আমার শব্দগুলো অবহেলায় নিঃশেষ হয়েছে। আমি শরীর চাইনি কোনোদিন, শরীর তো সেই আলেয়া যে প্রেমের পথে বিভ্রান্তি জাগায়। অথচ শরীরের প্রতি এখন ওর তেমন আড়ষ্ঠতা ছিলনা। একদিন ওর হাত ধরতে পারাটা ছিল চাঁদ ছোবার মত রোমাঞ্চকর।
এখন বাতাসে সেই সব স্মৃতি পুড়ে যায় অবহেলায়। সারাঘরময় প্রদর্শনী চলছে মৃত্যুর। রক্তে নটরাজের উদ্দামতায় আমি পাগলের মত ওর বুকটা ফেড়ে ফেলি, হৃৎপিন্ডটা হাতে নেই। এই হৃদয়ই কি একদিন আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল!! আমার ঘৃণা হয় ওর হৃৎপিন্ডের প্রতি।
ওর কপালের ওপর হৃৎপিন্ডটা রেখে আমি কয়েকশো টুকরো করি। একটা কুকুর বাইরে প্রচন্ডভাবে চিৎকার করছে…
ওর লাশ ঢাকা চাদরে লাল রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে। ওর স্রোতপাকের মত নাভিতে রক্ত গড়িয়ে এসে পুকুর হয়ে আছে। ওর শরীরে কোন তাপ নেই। আমার কান্না পাচ্ছে। কিছু পিঁপড়া সেই কান্নাদৃশ্য দেখতে এসেছে। কিন্তু আমি কাঁদবো না। কারণ আর কোনদিন পৃথক হতে পারবে না ও। লিও রোজাসের প্যান ফ্লুট বাজছে। আমি আমার শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখি বিশ্রী শরীরে একটা পুরুষ নেতিয়ে ঝুলছে। আমার চামড়া ভেদ করে ভেতরের সমস্ত তরল বের হয়ে আসতে চায়। আমার পুরুষটি খুব ছোট হয়ে মুখ বের করে এইসব অভিজ্ঞতা দেখে। আমি পুরুষটিকে কেটে ফেলি খুব অনাগ্রহে । আমার ভাবনার অতীত ব্যাথায় আমি কুকড়ে যাই। পুরুষটিকে শুইয়ে রাখি ওর শরীরের উপর যেভাবে চিতার উপর রাখা হয় মৃত। আমার ভেতর যন্ত্রণা, শতমাইল বিস্তৃত আগুনের উত্তাপ। আমি ১১ মাত্রার ভূমিকম্পের মত কাঁপছি। বীর্য নয়, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। আমরা এখন আর কেউ নারী কিংবা পুরুষ নই। ফলে ও আর আমি এখন অবিচ্ছেদ্য। আমার চোখে হ্যালোছিনেশন ফুল, দেখলাম সারা ঘর উপরে উঠে যাচ্ছে এবং তারা যাচ্ছে স্বর্গের দিকে, স্বর্গের দরজা খুলে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে হলে একটা কন্ঠনালী কাটতে হবে। আমার কন্ঠনালীর চাইতে উত্তম কন্ঠনালী আর এ মুহূর্তে পাওয়া যাবেনা…